বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:০৫ অপরাহ্ন

মাস্কসহ চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনায় দুর্নীতির অভিযোগ টিআইবি’র

মাস্কসহ চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনায় দুর্নীতির অভিযোগ টিআইবি’র

স্বদেশ ডেস্ক:

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতে মাস্কসহ সুরক্ষা সামগ্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতি উদ্বেগজনকহারে বৃদ্ধির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ- টিআইবি বলেছে, এখন সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা অনুসরণ না করে স্বাস্থ্যখাতের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে কেনাকাটা করা হচ্ছে এবং তাতে অনেক জিনিস বাজার মূল্যের কয়েকগুণ বেশি দামে কেনার মতো অনিয়ম হচ্ছে।

সংস্থাটি আরো বলেছে, মহামারির সময় পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে স্বাস্থ্যখাতের এক শ্রেণির কর্মকর্তার সহায়তায় কেনাকাটায় অনিয়ম দুর্নীতি করার চিত্র তাদের গবেষণায় ফুটে উঠেছে।

দুর্নীতি দমন কমিশন বলেছে, দেশে করোনাভাইরাস শুরুর আগের কয়েক মাসে তারা স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির অভিযোগে ১১টি মামলা করেছে এবং এখন সুরক্ষা সামগ্রীর দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিচ্ছিন্ন দু’একটি ঘটনা ছাড়া স্বাস্থ্য খাতের সব কেনাকাটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে করা হচ্ছে।

দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর পরই গত মার্চ মাসে সরকারের কেন্দ্রীয় ঔষাধাগার থেকে সরবরাহ করা এন৯৫ মাস্ক এবং পিপিইসহ স্বার্স্থকর্মীদের সুরক্ষা সামগ্রীর মান নিয়ে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছিল।

ঢাকার মুগদা জেনারেল হাসপাতাল থেকে কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছেল যে, প্যাকেটে এন৯৫ লেখা থাকলেও নিম্নমানের মাস্ক এবং পিপিই দেয়া হয়েছে।

তখন ব্যাপক আলোচনার মুখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তদন্ত করলেও তার ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড: ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, সুরক্ষা সামগ্রীতেই দুর্নীতি থেমে থাকেনি। চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রেও উদ্বেগজনকহারে দুর্নীতি বৃদ্ধির তথ্য তারা গবেষণায় পেয়েছেন।

‘ব্যাপকভাবে আলোচনা শুরু হয় এন৯৫ মাস্ক ক্রয়ের কেলেঙ্কারি নিয়ে। এরপরে আরো দেখা যাচ্ছে, কেনাকাটায় এই একই ধরণের অনিয়ম হচ্ছে। এমনকি মৌখিকভাবে কার্যাদেশ দেয়া হচ্ছে। আসলে এটা যোগসাজশ করে আদায় করা হচ্ছে। যে ব্যবসায়ী বা সরবরাহকারী রয়েছে, তাদের সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার সাথে থাকা কর্মকর্তাদেরও কেউ কেউ এই অনিয়মের অংশীদার হচ্ছেন।’

তিনি আরো বলেছেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে অবকাঠামো দূর্বল, এটা নতুন কথা নয়। কিন্তু এখন কোভিড-১৯ সঙ্কটের কারণে এটা আরো ব্যাপকভাবে প্রকাশ হলো বা জানা গেলো। দেখা যাচ্ছে, যে সব জিনিস ক্রয় করা হচ্ছে, সেটার জন্য বাজারের যে মূল্য, তার থেকে পাঁচ থেকে দশ গুণ বেশি মূল্যে কেনা হচ্ছে। এ রকম সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে। এটা ব্যাপকহারে হচ্ছে।’

ড: ইফতেখারুজ্জামানের বক্তব্য হচ্ছে, যেহেতু স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহালদশা অনেক পুরোনো। সেজন্য এখন মহামারি সামাল দিতে এই খাতে চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যাপকহারে কিনতে হচ্ছে। আর এই কেনাকাটা তাৎক্ষণিক নির্দেশে এবং অনেক ক্ষেত্রে মৌখিকভাবে করা হচ্ছে, এমন চিত্র তারা পেয়েছেন।

মাস্কসহ সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক কোন ব্যবস্থা না নেয়ার কারণেও দুর্নীতি বন্ধ করা যায়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

এখন করোনাভাইরাস সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ক অনেক ভিডিও তৈরি করা হচ্ছে এবং অনেক ধরণের প্রচারণাও চালানো হচ্ছে।

এসব কাজের ক্ষেত্রেও অর্থ ব্যয়ের স্বচ্ছ্বতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনকারিদের। তারা বলেছেন, কেনাকাটা এবং প্রচারণার কাজের জন্য নতুন নতুন ব্যক্তিগত কিছু প্রতিষ্ঠান গজিয়েছে, এমন তথ্যও তারা পেয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাসরিন সুলতানা মনে করেন, স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটায় দুর্নীতির সাথে যে ঠিকাদার বা সরবরাহকারিরা জড়িত থাকে বিভিন্ন সময়, এখন করোনাভাইরাস দুর্যোগের সুযোগ নিয়ে সেই শ্রেণি আরো নগ্নভাবে তা করছে।

‘স্বাস্থ্য খাতে যে দুর্নীতি, তা কোভিড-১৯ এর প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে কতটা দুর্নীতি হয়। কেনাকাটার ক্ষেত্রেই দুর্নীতিটা বেশি হচ্ছে। মেডিসিন যেসব সরকারিভাবে কেনা হচ্ছে, সেগুলো ভালো কোম্পানি থেকে নেয়া হচ্ছে না। এমন সব কোম্পানি থেকে এমন সব ওষুধ নেয়া হচ্ছে, যেগুলো ডাক্তাররা প্রেসক্রিপশনেও লেখে না।’

‘‘আমাদের আইসিইউ’র অভাব আছে, অক্সিজেনের অভাব আছে। বিভিন্ন জিনিসের অভাব আছে। আর এসব কেনাকাটায় আমরা দুই টাকার জিনিস দুই হাজার টাকা পর্যন্ত দেখাচ্ছি। এখন এই দুর্যোগে যে সঠিক জিনিসটা দেয়া প্রয়োজন, তারা সেটাই ভুলে গিয়েছে।’’

স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তবে গত বছরের শেষে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পর্দা কেনা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছিল।

হাসপাতালটিতে যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন জিনিস কেনাকাটার ক্ষেত্রে একটি পর্দা কিনতেই দাম দেখানো হয়েছিল ৩৭ লাখ টাকা। এমন অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে।

দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর আগের চার মাসে অর্থ্যাৎ গত বছরের নভেম্বর থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সময়ে পর্দা কেলেঙ্কারিসহ স্বাস্থ্যখাতে দুদক ১১টি দুর্নীতির মামলা করেছে। এখন মাস্কসহ সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করা হচ্ছে বলে দুদক চেয়ারম্যান উল্লেখ করেছেন।

‘স্বাস্থ্যখাতে অভিযোগ আমরা আগে থেকেই পাচ্ছিলাম। এবং আমরা এ পর্যন্ত প্রায় ১১টি মামলা করেছি এ খাতের কেনাকাটার বিষয় নিয়ে। অনেকেই বিহাইন্ড দ্য বার গেছেন। অনেকে আবার দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। ১১টি মামলার আসামি অনেক। এখানে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা কর্মচারীরাও রয়েছে। আমরা এই দুর্নীতিগুলো বন্ধ করার চেষ্টা করছিলাম। এরইমাঝে মাস্ক, পিপিই নিয়ে অভিযোগ এসেছে এবং তা অনুসন্ধান করা হচ্ছে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’

তিনি আরো বলেছেন,‘এরই মাঝে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর মাস্কসহ সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে। সেটা আমরা টিম গঠন করে দিয়ে অনুসন্ধান করছি।’

করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই অর্থ ব্যয়ে দুর্নীতি রোধ করা কতটা সম্ভব হবে-তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলকারিরা।

তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেছেন, মাস্কসহ সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে অনিয়মের অভিযোগের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

এটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেছেন, সরকারি নীতিমালা অনুসরণ করে জরুরিভিত্তিতে স্বাস্থ্যখাতের সব কেনাকাটা করা হচ্ছে স্বচ্ছতার সাথে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877